জসিম মাহমুদ : 
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে টেকনাফ উপজেলায় আশ্রয় নেওয়া অসহায় রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রা কাহিল হয়ে পড়েছে । শীতের শুরুতে (ঠান্ডা) কম হলেও গত কয়েকদিন ধরে বয়ে যাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। নারী-শিশু ও বয়স্ক রোহিঙ্গারা ছাড়াও ঝুপড়ি ঘরসহ শিবিরের বাইরে থাকা রোহিঙ্গারা প্রচন্ড শীতে কাঁপছে। ফলে নারী-শিশুরা শীতবস্ত্রের অভাবে ঠা-াজনিতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বুধবার বিকালে টেকনাফ উপজেলার নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত শিবির ও শিবিরের বাইরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা বস্তিতে ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
টেকনাফের মৌচনি নিবন্ধিত শিবিরের প্রধান সড়কের সামনে গড়ে উঠেছে নতুন করে শতাধিক রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ি ঘর। সেখানে অনেকের ঘরে ছাউনি থাকলেও নিচে কাদা মাঠিতে বসবাস করছে। এমন এক রোহিঙ্গা নারী তসলিমা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তার বাড়ি মিয়ানমার কিলাডং গ্রামে। তিনি জানান, শীত শুরুতে তেমন বেশি শীত লাগেনি। কিন্তু গত দুইদিন ধরে ঠান্ডায় খুব কষ্টে হচ্ছে। কথা বলার সময় কোলে ছিল ৫ মাস বয়সের শিশু মিনারা বেগম। তার সর্দি-কাশির প্রভাবে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বিরামহীনভাবে কেঁদে চলেছে। পাশে থাকা অপর দুই সন্তান মামুন ও শফিকার গায়েও গরম কাপড়চোপড় নেই। হাত পা গুটিয়ে মায়ের পাশে বসে আছে।
টেকনাফ মৌচনি প্রধান সড়কের সামনে ঝুপড়ি ঘরে নতুন আসা রোহিঙ্গা তসলিমা আক্তার জানান, এক কাপড়ে তাঁরা মিয়ানমার ছেড়েছেন। গরম কাপড় তো দূরে, প্রাণ নিয়ে আসাটাও ছিল দুরূহ। এখন শীতে কষ্ট পাচ্ছে সন্তানেরা। মিনারা বেগম অসুস্থ হলেও তাকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। টেকনাফের নয়াপাড়া ত্রাণ কেন্দ্রের পাশে ধানে জমিতে নতুন করে ঘর তৈরী করতে দেখা যায়। শুধু ঘরের ছাউনি দিতে পেরেছেন কেউ কেউ। তাদের মধ্যে অনেকে আবার ছাউনি দিতে পারেনি। বাঁশের বেড়া ও পলিথিনের ছাউনিযুক্ত ১৫ ফুট লম্বা একটি ঝুপড়িঘরে গাদাগাদি করে থাকছেন পরিবারের ২০ নারী ও শিশু। নারীদের সঙ্গে আছে পাচঁ মাস থেকে ছয় বছর বয়সী অন্তত ৫ জন শিশু। ঠান্ডায় (শীতে) বেশির ভাগ শিশু সর্দি-জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত। কিছু শিশুর গায়ে কাপড়ও নেই। আমরা কেউ ইচ্ছা করে এখানে পালিয়ে আসিনি। আত্মীয়স্বজন, ঘরবাড়ি-সহায়সম্বল সবকিছু হারিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, শিশুদের কান্নাকাটি আর হইচইয়ের জন্য এই ঝুপড়িঘরে কারও ঘুম হয় না। রাতে ঝুপড়িঘরের বাঁশের বেড়া দিয়ে যখন ঠান্ডা বাতাস ঢোকে তখন শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করে। একটা কম্বল কিংবা গরম কাপড় দিয়ে শিশুদের শীত নিবারণেরও কোনো জো-নেই। এর মধ্যেও খাবারের সংকটও চলছে।
এদিকে টেকনাফে লেদা ও নয়াপাড়ার দুই শিবিরে আগে থেকে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। সম্প্রতি ঢুকে পড়েছে আরও প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। তার আশপাশে রয়েছে প্রায় লাখ খানেক। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। নতুন আসা রোহিঙ্গারা ঝুপড়ি ঘর তৈরী করে, অনেকে শুধু ছাউনি দিয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছে।
টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবদুল মতলব বলেন, মিয়ানমার থেকে নিঃস্ব হয়ে প্রাণে বেচেঁ বাংলাদেশে পাহাড়, জঙ্গল ও খোলা জায়গাতে আশ্রয় নিয়েছেন। মাথাগোঁজার ঠাঁই এবং খাদ্য সামগ্রী কিছুটা ফেলেও এখনো তাদের ভাগ্যে জোটেনি প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র। তাই বর্তমানে প্রতিদিন সন্ধা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে (শীতে) ঠান্ডায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে অসহায় মানুষগুলো। পাশাপশি ক্যাম্পগুলোতে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত নানা রোগ-ব্যাধি। কেউ কেউ শীতবস্ত্রের বদলে আগুনই জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করে রাত পাড়ি দিচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার ঠান্ডাজনিত রোগে এক বৃদ্ধা রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। তাকে স্থানীয়ভাবে দাফন করা হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া বলেন, শীতকালে পাহাড় ও জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া নারী-শিশুরাও ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এর মধ্যে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, সর্দি-জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, চর্মরোগ, ইনফেকশন, রক্ত ঝরা ও চোখের এলার্জিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। তবে সকলে যাতে চিকিৎসা সেবা পায় সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন ২৫০-৩০০ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তবে শীতকাল আসার পর থেকে রোগীর সংখ্যাটা বেড়েছে।